Thursday, May 15, 2014

বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের সংস্কৃতি

"মধুর সমস্যায় পড়েছেন বৃষ্টি শিকদার ও সৌরভ দাশ।

বৃষ্টি শিকদার ও সৌরভ দাশ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক), স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ডিউক ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের নামীদামি ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। কিন্তু বেছে নিতে পারবেন মাত্র একটি। কোনটি বেছে নেবেন এই দুই মেধাবী? [12]"

এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে?


সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড সংস্কৃতি সূচনার মাধ্যমে। 

সেই গল্পই বলছি আজকে।

শুনতে থাকুন! 



বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের সংস্কৃতির সূচনার পর বেশকিছু ব্যাপার আমরা লক্ষ্য করছি।

আমরা লক্ষ্য করছি, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে প্রতিদিনের একটা বড় অংশ গভীর আগ্রহ নিয়ে গাণিতিক সমস্যা সমাধানে  ব্যয় করে।

স্কুল কলেজে আমরা গণিত বলতে exercise করি - কিছু নির্দিষ্ট ধাপ বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যালগরিদম মেনে চলি মাত্র। কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডের সমস্যাগুলো সমাধানে ধাপগুলো বা অ্যালগরিদমটা নিজেকে দাঁড় করাতে হয়। অন্যকথায়, গণিত সৃষ্টি করতে হয়।

একটা উদাহরণ দেই।

দুটা সংখ্যাকে গুণ করতে আমরা না বুঝেই কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলি - প্রথমে দুটি সংখ্যার সবচেয়ে ডানের অঙ্ক দুটিকে গুণ করি, তারপর হাতে রাখি ইত্যাদি।

কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডের সমস্যাগুলো সমাধানে এই ধাপ বা নিয়মগুলো - কোন ধাপের পর কোন ধাপ হবে - নিজেকে চিন্তা করে বের করতে হয় - অর্থাৎ গণিত সৃষ্টি করতে হয়।

আমরা বলি, স্কুল কলেজে তোমরা exercise কর, আর আমরা গণিত অলিম্পিয়াডে problem solve করি। কাজেই এখনও যারা Problem Solving কর না, আশা করি, তোমরাও দ্রুত আমাদের দলে যোগ দেবে!

যারা Problem Solving করে তাদের অনেক ভাবতে হয়। ভাবতে গিয়ে তাদের "নিউরনে অনুরনন" হয় এবং তারা অনেক ভালভাবে চিন্তা করতে, বিশ্লেষণ করতে শেখে। গণিত অলিম্পিয়াড সূচনার পর একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যাদের গড় IQ আগের প্রজন্মগুলোর তুলনায় বেশি। নতুন প্রজন্মের এই ছেলেমেয়েরা অনেক ভালভাবে চিন্তা করতে পারে। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক এ নিজের ছবি দেখা, বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজ দেশকে represent করা - অনেক বড় inspiration। 

এই মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো যখন দেশ ও সমাজের দায়িত্ব নেবে, তখন আমরা নতুন একটা দেশ গড়ে তুলবো। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতির জন্য আমাদের কিশোর তরুণ গণিতবিদদের একটা ছোট্ট কাজ করতে হবে। গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে চিন্তা করার, বিশ্লেষণ করার যে ক্ষমতা বিকশিত হয়েছে, সেই ক্ষমতাকে আশেপাশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করা শুরু করতে হবে।  

আমরা লক্ষ্য করেছি, গণিত অলিম্পিয়াডের অনুষ্ঠানগুলোতে অনেক ভাল ভাল কথা হয়। আলোকিত মানুষ হওয়ার, দেশকে ভালবাসার অনুপ্রেরণা পায় ছেলেমেয়েরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দেশের গুণী মানুষদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়, প্রশ্ন করতে পারে, কথা বলতে পারে এবং এমনকি চাইলে অটোগ্রাফও নিতে পারে!


দুটা চমৎকার ব্যাপারের


  • একটা হল “গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো” থিম - অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিজের জীবন নিয়ে দেশ নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখছে এবং তার চেয়েও বড় কথা স্বপ্নগুলোকে বিশ্বাস করছে [14]। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী দেশের শিশুকিশোর গণিতবিদদের কাছে যে ৩টি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তাদের মাঝে ছিল ২০২২ সালের মধ্যে একজন বাংলাদেশী গনিতবিদের ফিল্ডস মেডল জয় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর নোবেল পুরষ্কার জয়। আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদরাও এই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে নিজেদের তৈরি করছে। 
  • আরেকটা হল একেবারে ক্লাস থ্রি - ফোরের ছেলেমেয়েরা ড. জাফর ইকবালের ভাষায় “পেন্সিল কামড়ে” অঙ্ক করতে আসে!


আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলা মাধ্যমের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেল এ পড়ার সুযোগ পেয়েছে। মুন পড়ছে Harvard University তে [1], নাজিয়া MIT তে [2] (তা নাহলে "MIghTy" শব্দটা এভাবে লেখা আমরা কোত্থেকে শিখতাম!), ইশফাক Stanford University তে [3], তানভির Caltech এ [4] (আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে Post-Doctoral Researcher হিসেবে কর্মরত ছিলেন) [5], সামিন Cambridge University তে [6]।

আগে অ্যামেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার গ্রাজুয়েট স্কুলগুলোতে আমরা এমএস বা পিএইচডি করতে যেতাম। ইংরেজি মাধ্যমের অবস্থাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা পড়তে পারত আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে। কিন্তু “বাংলা মাধ্যম” থেকে "স্কলারশিপ নিয়ে" “আন্ডার গ্রাজুয়েট” লেভেলে “বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে” পড়তে যাওয়াটা নতুন!

“বাংলা মাধ্যম” থেকে "স্কলারশিপ নিয়ে" “আন্ডার গ্রাজুয়েট” লেভেলে “বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে” পড়ার পথ দেখানোর কৃতিত্বের একক দাবিদার বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ ড. মাহবুব মজুমদার  [7]; যিনি নিজে MIT থেকে Electrical Engineering এ আন্ডারগ্রাড, Stanford University থেকে Civil Engineering এ মাস্টার্স এবং Cambridge University থেকে Theoretical Physics এ PhD করে Imperial College এ [8] Post Doctoral করছিলেন। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে থেকে যান। বিদেশী ও ইঞ্জিনিয়ারিং আন্ডারগ্রাড ডিগ্রি থাকা এবং আরও কিছু হাস্যকর কারণ দেখিয়ে তাকে Dhaka University র Physics Department এ যোগ দিতে দেওয়া হয়নি [9]। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশে একটা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। তার মত ভাল মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। আমরা তার পাশে থাকবো।

১৯০৫ এ আইনস্টাইনের "Miracle Year" [10] স্মরণে ২০০৫ সালের বাংলাদেশ জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে আইনস্টাইন এবং পদার্থবিজ্ঞানের উপর একটা প্রশ্ন উত্তর পর্ব ছিল। সেখানে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। তাই গণিত ক্যাম্পে ড. মাহবুব মজুমদার আগ্রহের সাথে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতেন। মেক্সিকোতে যাওয়ার আগে প্রেস কনফারেন্সে দেখি তিনি স্ট্রিং থিউরি (String Theory) র [11] একটা পেপার নিয়ে হাজির!   

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মত। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের সাফল্যের মাত্রা দ্রুত বাড়ছে [15] [16]। আমাদের কিশোর - তরুণ গণিতবিদরা ২০০৬ সালে প্রথমবারের মত অনারেবাল মেনশান, ২০০৯ সালে প্রথমবারের মত ব্রোঞ্জ মেডেল, ২০১২ সালে প্রথমবারের মত সিলভার মেডেল জয় করে এনেছে। আমরা আশা করছি, এই ধারা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ গণিত দল ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে গোল্ড মেডেল নিয়ে ফিরবে! গোল্ড মেডেল জয়ী সেই গণিতবিদ হতে পারো তুমিই!

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পাশাপাশি আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদরা এশিয়ান-প্যাসিফিক ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াডে (এপিএমও) অংশগ্রহণ করছে এবং পদক জয় করে আনছে [16]।

আমি শিরোনামে "সংস্কৃতি" শব্দটির উল্লেখ করেছি। এর সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্যই বাংলাদেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গণিত তথা মেধার চর্চা। কিন্তু এই মেধা চর্চার ঢেউ এসে লেগেছে আমাদের সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে, নানা অংশে। গণিত চর্চার জন্য প্রকাশিত হচ্ছে বই [13]। একুশের বই মেলায় গণিতের বইয়ের স্টলে ভিড় জমাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে নিয়মিত গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছে [17]।

গণিত অলিম্পিয়াড সূচনা এবং সাফল্যের পর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছে।


  • পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড 
  • রসায়ন অলিম্পিয়াড
  • জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড 
  • প্রাণরসায়ন অলিম্পিয়াড
  • ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড 
    • কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। আমাদের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা এখন আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় মেডেল জয় করে আনছে! ভাবা যায়!  


গণিত অলিম্পিয়াডের এই সংস্কৃতি সম্ভব হয়েছে কিছু তরুণ - তরুণীর স্বেচ্ছা কর্মোদ্যোগে। আমরা তাদের "মুভারস" (MOVERS - Math Olympiad Volunteers) বলে জানি। একটা শুভ উদ্যোগে দেশের তরুণ তরুণীদের উৎসাহী অংশগ্রহণ আমাদের প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণ প্রজন্মকে সংজ্ঞায়িত করে।


নাগরিক শক্তি গণিত অলিম্পিয়াডের এই সংস্কৃতিকে দেশে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবে।





- ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক; সভাপতি, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

তরুণ প্রজন্ম এখন নেতৃত্ব নিতে সক্ষম
- ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিভাগীয় প্রধান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ভর্তি, মান ও দক্ষ জনশক্তি
- ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।



তোমাদের জন্য লেখা






আরও কিছু লেখা





বাংলাদেশে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড





রেফরেন্স
  1. Harvard University
  2. MIT
  3. Stanford University
  4. California Institute Of Technology
  5. Dr. Muhammed Zafar Iqbal
  6. Cambridge University
  7. Dr. Mahbub Majumdar
  8. Imperial College
  9. A painful funny story
  10. Einstein's Miracle Year
  11. String Theory
  12. এমআইটির পথে...
  13. গণিতের জাদু বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
  14. গণিত শেখো স্বপ্ন দেখো: জাতীয় গণিত উৎসব বিশেষ সংখ্যা: ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা
  15. আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড: এবার তিনটি ব্রোঞ্জ পেল বাংলাদেশ
  16. এপিএমওতে বাংলাদেশের দুটি ব্রোঞ্জ পদক
  17. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক গণিত অলিম্পিয়াড

No comments:

Post a Comment