Thursday, March 6, 2014

পিলখানা ট্র্যাজেডিঃ ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হোক

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি অংশ নিয়েছেন আদালতে তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যতদিন মূল পরিকল্পনাকারীদের বিচার হবে না, ততদিন ভবিষ্যতে আবারও ষড়যন্ত্রের এবং এই ধরণের হত্যাকাণ্ড সংঘঠনের আশঙ্কা থেকে যাবে। আমরা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারিদের - তারা যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, দেশী বিদেশী যত বড় শক্তিই পিছনে থাকুক না কেন - বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চাই।


"সাম্প্রতিক ইতিহাসে একুশের মাস ফেব্রুয়ারিতেই এক মহা কলঙ্কময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ঘটানো হয় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড, এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় খুন হন টগবগে চৌকস সেনাবাহিনীর দক্ষ ৫৭ জন অফিসার। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ হত্যাযজ্ঞ চলে এক পৈশাচিক উন্মাদনায়। মেজর জেনারেল থেকে নিম্নে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত সব র‌্যাংকের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয় পিলখানার বধ্যভূমিতে। হত্যার শিকার হন মহাপরিচালক, পরিচালকেরা, ব্যাটালিয়ন কমান্ডাররা ও অধিনায়কেরা। তাঁদের স্ত্রী-কন্যারাও রক্ষা পাননি, চরমভাবে সবাই লাঞ্ছিত হন, নৃশংসভাবে খুন হন।

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এই মহানারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিটি স্তরের ঘটনার ধারাবাহিকতা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘটনার অতি গভীরে সূক্ষ্ম তদন্ত। ঘটনা-পূর্ব, ঘটনাকাল ও ঘটনা-পরবর্তী প্রতিটি বিষয় গভীর অনুসন্ধিৎসু চোখের বিশ্লেষণে সত্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন কার্যকারণের বিস্তারিত সুদূরপ্রসারী পর্যালোচনা। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়। নয় বিডিআর সদস্যদের সাধারণ অসন্তোষ ও অভিযোগের ফল, কিংবা নিছক ডাল-ভাত কর্মসূচির হিসাবের গরমিলের বিস্ফোরণও নয়। অনেকেই বিশ্বাস করে এর নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। দেশের ও বাইরের অপশক্তির যোগসাজশের কথাও বলেছে অনেকে। বাংলাদেশের মানুষ জাতির এ মহা কলঙ্কময় ঘটনার নেপথ্যের খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন দেখতে চায়, পরিকল্পনাকারীদের দৃশ্যপটে হাজির দেখতে চায়, বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চায়।

আমরা যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছি। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছি। কর্মরত ও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যা, তাঁদের স্ত্রী ও কন্যাদের চরম লাঞ্ছনা নিশ্চয়ই মানবতাবিরোধী বড় অপরাধ। আমি সেই আলোকেই এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় ও যথাযথ বিচারের দাবি জানিয়ে এসেছি। দাবি জানিয়ে এসেছি মূল পরিকল্পনাকারীদের কাঠগড়ায় উপস্থিতির বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তির। এরা যারাই হোক না কেন, যত বড় শক্তিধর মহাপরাক্রান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই হোক না কেন। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা জাতির শত্রু, তারা চরম সন্ত্রাসী, তাদের অপরাধ অমার্জনীয়। জাতি কখনোই আমাদের কাপুরুষোচিত এ ব্যর্থতা ক্ষমা করবে না। প্রজন্মের কাছে আমরা দায়ী থাকব। যারা নেপথ্যে অধরা আছে, আছে দৃশ্যহীন, লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিরাপদ অভয়ারণ্যে, তাদের বিচারের জন্য জাতি অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে। কিন্তু বিচার আজ বা কাল হতেই হবে।

জঘন্য হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য হতে পারে বাংলাদেশের বীরোচিত সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করা, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়া। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে দুর্বল করা। সীমান্তকে বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত করা, জাতিকে অস্থিতিশীল করা।

আমরা আর রক্তপাত চাই না। ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হোক। সংঘাত আর রক্তপাতের এই ধারা এখানেই শেষ হোক। সকল হিংসা-বিদ্বেষ ষড়যন্ত্র আর উন্মত্ততার সমাধি হোক। শান্তি, সমপ্রীতি ও সমৃদ্ধির এক শক্তিশালী উন্নত নতুন বাংলাদেশের উত্থান হোক।"

সূত্র - বধ্যভূমির নাম পিলখানা



"বাংলাদেশের ইতিহাস কখনোই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহ নামের সেই ভয়াবহ ঘটনাটির কথাটি ভুলতে পারবে না, যেখানে দেশমাতৃকার সেবায় অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে।
একটি ঘটনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এত অধিকসংখ্যক উচ্চ প্রশিক্ষিত মেধাবী সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর একটিও নেই।

যাঁরা একসঙ্গে এত বিশালসংখ্যক দক্ষ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার হত্যার বিষয়টি কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না, তাঁদের সবার কাছে সব সময় একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কেন এই ঘটনা ঘটল? তাঁরা নেপথ্যের কারণগুলো জানতে চান। আদালতের রায় ঘোষণার পরও সেই সব প্রশ্ন থেমে থাকেনি। এই বিদ্রোহের অনেক কিছুই দেশবাসীর কাছে অজানা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এর প্রকৃত কারণ এবং নেপথ্য ব্যক্তিদের সত্যের আলোয় আনতে হবে।

এত বড় একটি বিদ্রোহ কি কেবল বিডিআরের কয়েকজন ডিএডি সমমানের কর্মকর্তার পরিকল্পনা হতে পারে? তাঁরা কি বাইরের কোনো শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হননি? সরকারকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।

চলে যাওয়ার সময় আমাদের শহীদ ভাইয়েরা আমাদের বিহ্বল মানসিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে গেছেন। সময়মতো তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটুকু আমরা করতে পারিনি। জীবদ্দশায় নানা উপলক্ষে দেশে-বিদেশে তাঁরা আমাদের দেশকে গর্বিত করে গেছেন, তাঁরা তাঁদের বিক্রম দেখিয়েছেন, মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, সহকর্মীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজনের সময় আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কেন এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটল, কেন আমরা সময়মতো তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না, সেগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ভুল থেকে, দুঃখজনক সেই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষাটাই নিতে পেরেছি, সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

এসব বীর শহীদের অনেক বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা শোক আর ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান। এ রকম একটি উদ্যোগই গ্রহণ করেছে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কর্নেল মুজিবসহ সব শহীদ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। ২০০৯ সালে ভয়ানক সেই ঘটনার পরপরই ঘটনার অন্যতম শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের নামে শহীদ কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট গঠিত হয়।

জাতি হিসেবে আমরা এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না যে আমরা শুধু এই মূল্যবান জীবনগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি তা নয়, বরং দেশের জন্য এই বীরদের মূল্যবান অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে পারিনি। যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাঁরা আত্মত্যাগ করলেন, সেই প্রতিষ্ঠানটিও যেন আজ দ্বিধান্বিত, নয়তো কেন আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালিত হয় না। এই জাতির ইতিহাস আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ জাতি জানে কীভাবে শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হয়। আজ শহীদ সেনা দিবসের পঞ্চম বার্ষিকী পালন কালে আসুন আমরা যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের বীরদের স্মরণ করি।"

সূত্র - আর হারাতে চাই না!

No comments:

Post a Comment