"রাশিয়ার জার ও ভারতের মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।"
- ড. আকবর আলি খান [1]
"ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার শাসনকে বলে স্বৈরশাসন, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনকল্যাণমূলক বা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয় না।
সরকার যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় এবং জনকল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে না দেখা যায়, তবে তা নির্বাচিত হলেও গণতান্ত্রিক সরকার নয়, বরং তাকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলা যায়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের সংসদীয় দলের প্রধানের মতামত মানা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে সরকারপ্রধান দলীয় প্রধান ও সংসদীয় দলের প্রধান। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব যেকোনো মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে গ্রহণীয় করার জন্য দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম।
সংসদের সর্বোচ্চ পদ স্পিকার। এ পদের জন্য সংসদ সদস্যদের ভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচন ও অপসারণের ব্যবস্থা আছে। ফলে দলীয় যেকোনো ব্যক্তিকে স্পিকার নির্বাচন এবং পছন্দ না হলে যখন-তখন অপসারণের ক্ষমতা সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আছে।
সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের জবাবদিহির প্রধান জায়গা সংসদ। স্পিকার যিনি সংসদ পরিচালনার কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ও সংসদে সরকারি দলের সাংসদেরা যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সে কারণে ভোটের মাধ্যমে সংসদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করতে সক্ষম, তাঁরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। দেখা যায়, সংসদে সরকারি যেকোনো প্রস্তাব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই গৃহীত হয়। এ কারণে সংসদকে সরকারি সব কাজের বৈধতাদানকারী রাবার স্ট্যাম্প সংসদ হিসেবে অনেকে আখ্যায়িত করে থাকেন।
বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা, দেশের সচেতন সমাজের অনেকে ও ভুক্তভোগীদের কাউকে কাউকে আক্ষেপ করতে দেখা যায়, কাগজে-কলমে যা-ই থাক, বিচার বিভাগ তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা বাস্তবে লাভ করেনি। বাস্তবে সরকার বলতে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে বোঝায়। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে বললে বিচার বিভাগ এখনো সরকারপ্রধানের প্রভাবমুক্ত নয়।
রাষ্ট্রপতির পদটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসন। দল-মতনির্বিশেষে সবার আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা। সে লক্ষ্যে পদটি দলনিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি দ্বারা পূর্ণ করা বাঞ্ছনীয়। সংবিধানের বিধানগুলো কিছুটা সে লক্ষ্যে প্রণীত। কিন্তু বাস্তবে সংসদ সদস্যদের অগোপনীয় ব্যালটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাংসদেরা দলীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ও অনুগত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে বাধ্য থাকেন। এমনকি সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে (যেমনটা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ইতিপূর্বের বিএনপির ছিল) যখন-তখন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বাস্তবায়নে বা মন রক্ষা করে চলতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব।
বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারপ্রধান শুধু সরকারি প্রশাসনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক নন, একই সঙ্গে সরকারি দল ও সংসদের নিয়ন্ত্রক, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বিচার বিভাগ তার প্রভাবের আওতায়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদটি বর্তমান পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, যা বাধাহীনভাবে কোনো জবাবদিহি ছাড়া ব্যবহার করা যায়। এককথায় স্বৈরাচারী একনায়কত্ব। ফলাফল যা অনিবার্য, তা হলো ভুলত্রুটি, অনিয়ম, সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতির বিকাশ।
আগেই বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশাসনের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। সে কারণে সরকারপ্রধান পরোক্ষ ক্ষমতাগুলোও সরাসরি ব্যবহারের প্রয়াস নিলে তা সম্ভবপর হয়। ফলে সাধারণ দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে যেকোনো সমস্যা সমাধানে সরকারপ্রধান জড়িত হয়ে পড়েন এবং তাঁর নির্দেশনা ছাড়া কোনো কাজের অগ্রগতি হয় না।
যেহেতু সরকারপ্রধান সব কাজে জড়িত হয়ে পড়েন, সব ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, দুর্ঘটনা ও অঘটনের দায়-দায়িত্ব (যদি তিনি সরাসরি দায়ী না-ও হন) স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাঁর ওপরই বর্তায়। সেই দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে এ ধরনের সরকারপ্রধানদের ক্ষমতার বাইরে থাকা নিরাপদ হয় না। ফলে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এবং পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলীয়করণ, দুর্নীতি, দলীয় সন্ত্রাস লালন-পালন ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার প্রয়াসের অংশ বলে অনেকে মনে করেন।"
- এককেন্দ্রিক শাসনব্যস্থা আর নয়, গোলাম মোহাম্মদ কাদের, সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী।
রেফারেন্স
[1] জার, মোগল সম্রাট ও প্রধানমন্ত্রী
- ড. আকবর আলি খান [1]
"ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার শাসনকে বলে স্বৈরশাসন, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনকল্যাণমূলক বা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয় না।
সরকার যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় এবং জনকল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে না দেখা যায়, তবে তা নির্বাচিত হলেও গণতান্ত্রিক সরকার নয়, বরং তাকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলা যায়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের সংসদীয় দলের প্রধানের মতামত মানা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে সরকারপ্রধান দলীয় প্রধান ও সংসদীয় দলের প্রধান। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব যেকোনো মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে গ্রহণীয় করার জন্য দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম।
সংসদের সর্বোচ্চ পদ স্পিকার। এ পদের জন্য সংসদ সদস্যদের ভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচন ও অপসারণের ব্যবস্থা আছে। ফলে দলীয় যেকোনো ব্যক্তিকে স্পিকার নির্বাচন এবং পছন্দ না হলে যখন-তখন অপসারণের ক্ষমতা সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আছে।
সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের জবাবদিহির প্রধান জায়গা সংসদ। স্পিকার যিনি সংসদ পরিচালনার কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ও সংসদে সরকারি দলের সাংসদেরা যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সে কারণে ভোটের মাধ্যমে সংসদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করতে সক্ষম, তাঁরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। দেখা যায়, সংসদে সরকারি যেকোনো প্রস্তাব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই গৃহীত হয়। এ কারণে সংসদকে সরকারি সব কাজের বৈধতাদানকারী রাবার স্ট্যাম্প সংসদ হিসেবে অনেকে আখ্যায়িত করে থাকেন।
বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা, দেশের সচেতন সমাজের অনেকে ও ভুক্তভোগীদের কাউকে কাউকে আক্ষেপ করতে দেখা যায়, কাগজে-কলমে যা-ই থাক, বিচার বিভাগ তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা বাস্তবে লাভ করেনি। বাস্তবে সরকার বলতে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে বোঝায়। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে বললে বিচার বিভাগ এখনো সরকারপ্রধানের প্রভাবমুক্ত নয়।
রাষ্ট্রপতির পদটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসন। দল-মতনির্বিশেষে সবার আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা। সে লক্ষ্যে পদটি দলনিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি দ্বারা পূর্ণ করা বাঞ্ছনীয়। সংবিধানের বিধানগুলো কিছুটা সে লক্ষ্যে প্রণীত। কিন্তু বাস্তবে সংসদ সদস্যদের অগোপনীয় ব্যালটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাংসদেরা দলীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ও অনুগত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে বাধ্য থাকেন। এমনকি সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে (যেমনটা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ইতিপূর্বের বিএনপির ছিল) যখন-তখন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বাস্তবায়নে বা মন রক্ষা করে চলতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব।
বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারপ্রধান শুধু সরকারি প্রশাসনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক নন, একই সঙ্গে সরকারি দল ও সংসদের নিয়ন্ত্রক, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বিচার বিভাগ তার প্রভাবের আওতায়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদটি বর্তমান পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, যা বাধাহীনভাবে কোনো জবাবদিহি ছাড়া ব্যবহার করা যায়। এককথায় স্বৈরাচারী একনায়কত্ব। ফলাফল যা অনিবার্য, তা হলো ভুলত্রুটি, অনিয়ম, সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতির বিকাশ।
আগেই বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশাসনের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। সে কারণে সরকারপ্রধান পরোক্ষ ক্ষমতাগুলোও সরাসরি ব্যবহারের প্রয়াস নিলে তা সম্ভবপর হয়। ফলে সাধারণ দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে যেকোনো সমস্যা সমাধানে সরকারপ্রধান জড়িত হয়ে পড়েন এবং তাঁর নির্দেশনা ছাড়া কোনো কাজের অগ্রগতি হয় না।
যেহেতু সরকারপ্রধান সব কাজে জড়িত হয়ে পড়েন, সব ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, দুর্ঘটনা ও অঘটনের দায়-দায়িত্ব (যদি তিনি সরাসরি দায়ী না-ও হন) স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাঁর ওপরই বর্তায়। সেই দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে এ ধরনের সরকারপ্রধানদের ক্ষমতার বাইরে থাকা নিরাপদ হয় না। ফলে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এবং পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলীয়করণ, দুর্নীতি, দলীয় সন্ত্রাস লালন-পালন ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার প্রয়াসের অংশ বলে অনেকে মনে করেন।"
- এককেন্দ্রিক শাসনব্যস্থা আর নয়, গোলাম মোহাম্মদ কাদের, সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী।
রেফারেন্স
[1] জার, মোগল সম্রাট ও প্রধানমন্ত্রী
No comments:
Post a Comment